বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত। মহাকাশে বাংলাদেশ স্বপ্নের সূচনা
Bangabandhu Satellite-1 (BS-1)
১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশজয়ের সূচনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু সেবছর ১৫ আগস্ট তাকে স্বপরিবারে হত্যার পর আর সব এগিয়ে চলার মতো এই যাত্রাও থেমে যায়। এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সরকার থমকে যাওয়া সেই যাত্রার প্রাথমিক শুরুটা করলেও ২০০১ সালে সরকার বদলে তা আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ২০০৯ এবং ২০১৪ পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ অবশেষে বাংলাদেশের মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ পায়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ চুক্তি
২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, স্যাটেলাইটের কাঠামো, উৎক্ষেপণ-ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা, ভূ-স্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা সহায়তা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। ফ্রান্সের থুলুজে স্যাটেলাইটটির মূল কাঠামো তৈরির কথা দেয় থ্যালেস।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়। মহাকাশে এই কক্ষপথের অবস্থান ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এই কক্ষপথ কেনা হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচিতি
‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ২৬ কু-ব্যান্ড এবং ১৪ সি-ব্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে।মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
স্যাটেলাইটের ধরণ: মহাকাশে প্রায় ৫০টির উপর দেশের দুই হাজারের উপর স্যাটেলাইট বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-আবহাওয়া স্যাটেলাইট, পর্যবেক্ষক স্যাটেলাইট, ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট ইত্যাদি। তবে বিএস-ওয়ান হল যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট।
এর কাজ: টিভি চ্যানেলগুলোর স্যাটেলাইট সেবা নিশ্চিত করাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রধান কাজ। এর সাহায্যে চালু করা যাবে ডিটিএইচ বা ডিরেক্ট টু হোম ডিশ সার্ভিস।
এছাড়া যেসব জায়গায় অপটিক কেবল বা সাবমেরিন কেবল পৌছায় নি সেসব জায়গায় এ স্যাটেলাইটের সাহায্যে নিশ্চিত হতে পারে ইন্টারনেট সংযোগ।
স্যাটেলাইটের ফুটপ্রিন্ট: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে। এর ফুটপ্রিন্ট বা কভারেজ হবে ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত।
শক্তিশালী কেইউ ও সি ব্যান্ডের মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালো কাভার করবে পুরো বাংলাদেশ, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া।
স্থায়িত্ব: ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে অরবিটাল স্লট কেনা হয়েছে। তবে বিএস ওয়ানের স্থায়িত্ব হতে পারে ১৮ বছর পর্যন্ত।
স্যাটেলাইট নির্মাণ: ৩.৭ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটির ডিজাইন এবং তৈরি করেছে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেস। আর যে রকেট এটাকে মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে সেটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স।
উৎক্ষেপণ হচ্ছে ফ্লোরিডার লঞ্চপ্যাড থেকে।
স্যাটেলাইট অপারেশন: আর্থ স্টেশন থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্যাটেলাইটটির কক্ষপথে যেতে সময় লাগবে ৮-১১ দিন। আর পুরোপুরি কাজের জন্য প্রস্তুত হবে ৩ মাসের মধ্যে।
এরপর প্রথম ৩ বছর থ্যালাস অ্যালেনিয়ার সহায়তায় এটির দেখভাল করবে বাংলাদেশ। পরে পুরোপুরি বাংলাদেশী প্রকৌশলীদের হাতেই গাজীপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়া আর্থ স্টেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে এটি।
পরিচালনায় বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট কোম্পানি
মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যত্রমের জন্য ইতিমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরী লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎক্ষেপণকারী রকেট
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করে এবছরের ৩০ মার্চ একটি বিশেষ উড়োজাহাজে উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দেয় থ্যালাম অ্যালেনিয়া স্পেস। মার্কিন রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালে কেনেডি স্পেস সেন্টারে স্পেসএক্সের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে উড়বে ‘ফ্যালকন নাইন’ রকেট।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু তথ্য
- নামঃ বঙ্গবন্ধু-১।
- স্যাটেলাইট তৈরীতে পৃথিবীতে ৫৭ তম, বাংলাদেশে প্রথম।
- বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহের মালিক।
- ওজন তিন দশমিক ৭ মেট্রিক টন।
- মহাকাশে অবস্থান করবে ১৫ বছর।
- গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায়
- উৎক্ষেপেণ করবে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স।
- বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস।
- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কক্ষপথে বহন করে নিয়ে যাবে স্পেস এক্স এর উৎক্ষেপণ যান ফ্যালকন-৯
- যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্পেস এক্সের লঞ্চিং স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে কক্ষপথের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে ফ্যালকন-৯
- মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে।
- বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি।
- ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার বিশিষ্ট এই স্যাটেলাইট এর ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশ ব্যবহার করবে এবং বাকী ২০ টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি সংস্থার কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে।
- ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করা যাবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কিছু সুবিধাসমূহঃ
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয় হবে, সেই সাথে অব্যবহৃত অংশ নেপাল, ভূটান এর মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আয় করা যাবে। কারন ৪০ টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে মাত্র ২০ টি ব্যবহার করবে বাংলাদেশ। আর বাকি ২০ টি ভাড়া দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে টিভি চ্যানেল আছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ টি। ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা আই এস পি আছে কয়েকশ। রেডিও স্টেশন আছে পনের টি এর উপরে। আরও আসছে। তাছাড়া ভি-স্যাট সার্ভিস তো আছেই।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু করতে পারলে দেশে শুধু বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয় হবে না, সেই সাথে অব্যবহৃত অংশ নেপাল, ভূটান এর মতো দেশে ভাড়া দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পারবে।কারণ ২০টি অন্যদেশে ভাড়া দেওয়া হবে।
বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট ভাড়ার জন্য যে টাকা দিতে হতো তা আর দিতে হবেনা।[td_smart_list_end]
যেসব উদ্দেশ্যে স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়ঃ
- মহাকাশ বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা
- আবহাওয়ার পূর্বাভাস
- টিভি বা রেডিও চ্যানেল, ফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রযুক্তি
- নেভিগেশন বা জাহাজের ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনায়
- পরিদর্শন – পরিক্রমা (সামরিক ক্ষেত্রে শত্রুর অবস্থান জানার জন্য)
- দূর সংবেদনশীল।
- মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে।
- মহাশূন্য এক্সপ্লোরেশন
- ছবি তোলার কাজে (সরকারের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ)।
- হারিকেন, ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এর পূর্বাভাস।
- আজকাল সন্ত্রাসীরা অনেক রিমোট এরিয়া তেও স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করছে।
- গ্লোবাল পজিশনিং বা জি পি এস।
- গামা রে বারস্ট ডিটেকশন করতে।
- পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং আসন্ন হামলা ছাড়াও স্থল সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য ইন্টিলিজেন্স সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা পেতে।
- তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিভিন্ন খনির সনাক্তকরণ ইত্যাদি
- ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করা।
http://www.spacex.com এর লিখিত নোটিশ